লোভ সামলানো যায় না এত ইলিশ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১ অক্টোবর থেকে সরকার ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে আগামীকাল রোববার রাত ১২টা ১মিনিট থেকে। নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরার অপরাধে গত ২০ দিনে বরিশালে ৪৬৩ জন (শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত) জেলেকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এবার যাদেরকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, কলেজ ছাত্র। পেশাদার জেলেরা নাকি নদীতে নামেনি।

জেলা মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার নদীতে এত পরিমাণ ইলিশ যে লোভ সামলাতে না পেরে অপেশাদাররা জেল-জরিমানার বিষয়টি ভুলে গিয়ে পাল্লা দিয়ে ইলিশ শিকারের চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার শখের বশেও ইলিশ ধরেছেন।

গত ২০ বছরেও এত ইলিশ নদীতে দেখা যায়নি। ফলে স্কুল-কলেজের ছাত্র থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ বাধা উপেক্ষা করে ইলিশ নিধন করেন। যারা প্রকৃত জেলে তারা ছিলেন সচেতন। সরকারি নির্দেশ তারা আগের তুলনায় এবার বেশি পালন করেছেন।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, গেলোবারের তুলনায় এবার তিনগুণেরও বেশি ব্যক্তিকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে ইলিশ ধরার অপরাধে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমরা যাদের আটক করেছি এদের অধিকাংশই মাছ ধরা পেশার সঙ্গে জড়িত নন। এলাকায় ব্যবসা করেন, চাকরিজীবী, স্কুল-কলেজের ছাত্র কিংবা বেড়াতে এসেছেন এমন লোকজনই লোভ সামলাতে না পেরে ইলিশ নিধনে নেমেছিলেন। নদীতে এত পরিমাণ ইলিশ যা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। মাত্র ১০/১২ হাত জাল নদীতে ফেলে ১০ মিনিট রাখলেই উঠে আসছে ২৫/৩০ কেজি ইলিশ। আমরা যখন স্পিডবোটযোগে অভিযানে যাই তখন মাছ ওপরে লাফিয়ে ওঠে। গত ২০ বছরে নদীতে এত ইলিশ দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে ইলিশ রক্ষা অভিযান সফল হওয়ায় ৩ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিকটন ইলিশ উৎপাদন হয়েছিলো। এবার আশা করছি ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ৫ লাখ মেট্রিকটন ছাড়িয়ে যাবে।

মৎস্য অধিদফতর বরিশাল বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক আজিজুল হক জানান, গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ১৭শ’ ২০টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে ৮১০টি। মামলা হয়েছে ৫০৭টি। জেল হয়েছে ৪৫২ জনের। যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় তিনগুণেরও বেশি। আটককৃত জেলেদের মধ্যে ১৮ জনকে দেয়া হয়েছে এক বছরের কারাদণ্ড। জরিমানা আদায় হয়েছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৬শ’ টাকা। জব্দ করা হয়েছে ৩৩ দশমিক ২৬ লাখ মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল। আর ইলিশ আটক হয়েছে ৮ দশমিক ৭৬ মেট্রিকটন। জব্দকৃত ইলিশ বিভিন্ন এতিমখানায় বিতরণ করা হয়।

এদিকে জেলেরা অভিযোগ করেছেন এই ২০ দিনে কোনো ধরনের সরকারি সহযোগিতা তাদের কপালে জোটেনি। ফলে জীবনের তাগিদে তারা নদীতে নামতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক এলাকায় আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা জেলেদের নদীতে মাছ ধরতে সহযোগিতা করেছেন। এর বিনিময়ে তাদেরকে দিতে হয়েছে চাঁদা। এই তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। অপরদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জব্দকৃত মাছ ভাগবাটোয়ারা করে ফ্রিজ বোঝাই করার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি উজিরপুরে মৎস্য কর্মকর্তা ও পুলিশের মধ্যে ইলিশ ভাগবাটোয়ারা করার একটি ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।

বরিশাল মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে ২০১২ সাল থেকে জেলেদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। বিশেষ প্রকল্পের আওতায় এই কার্যক্রমে নিবন্ধনের মাধ্যমে পরিচয়পত্র প্রদান করে প্রকৃত জেলেদের সনাক্তকরার উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় বিভাগের ছয় জেলার তিন লাখ ১৬ হাজার ১৪৪ জন জেলেকে নিবন্ধন করে পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়। যাদের মধ্যে এক লাখ ২৯ হাজার ৬৭৪ জেলেকে শুধুমাত্র ইলিশের ওপর নির্ভরশীল জেলে হিসেবে সনাক্ত করে সরকারি সহায়তার আওতায় আনা হয়। এ সকল জেলেদের জাটকা রক্ষার সময়ে ৪০ কেজি করে চার মাস এবং মা ইলিশ রক্ষার সময়ে ২০ কেজি করে চাল প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিগত বছরগুলোতে বিলম্বে হলেও এই চাল সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এবারই প্রথম নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের কোনো সহায়তা দেয়া হয়নি। তবে জেল-জরিমানা এবং শাস্তির ধারা ঠিকই বহাল রয়েছে। অর্থাভাবে ঋণের কিস্তি আর সুদের টাকা দিয়ে চলছে অনেক জেলে পরিবার।

মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মাল জানান, অভিযানকে সমর্থন জানিয়ে জেলেরা নদীতে মৎস্য শিকারে নামেননি। প্রতিশ্রুত সহায়তা প্রদান না করে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী নেতা ছালাম গাজী জানান, অভিযান সফল করার লক্ষ্যে আয়োজিত সমাবেশে বরিশাল জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান সকলের সামনে বলেছিলেন ‘আমি ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ত্রাণের বিষয়ে খোঁজ নেবো। কিন্তু অভিযান শেষ হয়ে গেলেও ত্রাণের খোঁজ আমরা এখনো পাইনি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর